হাওজা নিউজ এজেন্সি: কুরআনের নাসখ ও মানসূখ কখনোই ঐশী বাণীর পরিবর্তন বা সংশোধনের চিহ্ন নয়; বরং এ হলো সর্বজ্ঞ স্রষ্টার সেই অতুলনীয় হিকমত যিনি মানুষ ও সমাজকে ধাপে ধাপে, স্নেহে ও সাবধানে পরিপূর্ণতার শিখরে পৌঁছে দেন। যে আয়াতগুলোর বিধানের সময়সীমা শেষ হয়েছে, সেগুলো আজও কুরআনের পাতায় হেদায়েতের নূরে ভরপুর— তাশরী‘ঈ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে জ্বলজ্বল করছে।
কুরআন কেবল আইনের কিতাব নয়, এ হলো একটি উম্মাহর জন্ম ও বেড়ে ওঠার জীবন্ত কাহিনী। এই দীর্ঘ যাত্রায় কিছু আয়াত এসেছিল শুধুই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য— তারপর তাদের মিশন শেষ হলে নতুন, আরও পরিপূর্ণ বিধান তাদের স্থান গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেগুলো কখনো মুছে ফেলা হয়নি।
প্রশ্ন জাগে: যদি কোনো হুকুম পরে উঠিয়ে নেওয়ারই কথা ছিল, তবে প্রথম থেকেই তা আয়াত হয়ে কেন নাযিল হলো? আর হুকুম উঠে গেলে তা কুরআন থেকে মুছে ফেলা হলো না কেন? আর আজ আমরা মানসূখ আয়াত পড়ি কেন?
উত্তরের চাবিকাঠি হলো “নাসখ” শব্দের সঠিক অর্থ। নাসখ মানে ভুল সংশোধন নয়, পশ্চাত্তাপ নয়, ঐশী জ্ঞানে কোনো পরিবর্তন নয়; নাসখ মানে শুধু এই যে, একটি হুকুমের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং তার জায়গায় আরও উত্তম হুকুম এসেছে। প্রথম দিন থেকেই সেই হুকুমের সময়সীমা স্থির ছিল— কিন্তু সেটি মানুষের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। যখন নতুন আয়াত নাযিল হলো, তখনই সেই সময়সীমা স্পষ্ট হয়ে গেল।
তাহলে প্রশ্ন আসে— যে আয়াত পরে মানসূখ হবে জেনেও তা নাযিল করা হলো কেন? কারণ সেই আয়াত তখনকার সমাজের জন্য অপরিহার্য ছিল। নবীজির যুগের নতুন মুসলিম উম্মাহ সব একসঙ্গে চূড়ান্ত বিধান বহন করার শক্তি রাখত না। যেমন একটি শিশুকে প্রথম দিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম পড়ানো যায় না, তেমনি সমাজকেও ধাপে ধাপে উন্নীত করতে হয়। কিছু বিধান ছিল সেই সিঁড়ির ধাপ মাত্র— সেগুলো তাদের কাজ শেষ করে পরবর্তী ধাপের জন্য পথ ছেড়ে দিয়েছে।
তাই মানসূখ আয়াত কখনো অপ্রয়োজনীয় ছিল না। বরং তারা ছিল ইতিহাসের সেই মাইলফলক যা দেখিয়ে দেয় আল্লাহ কীভাবে ধীরে ধীরে একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তুলেছেন।
কিন্তু তাহলে এগুলো কুরআন থেকে মুছে ফেলা হলো না কেন? কারণ মুছে ফেলা মানে তাহরীফ। একবার যদি এই দরোজা খোলা হয় যে “মানসূখ আয়াত মুছে ফেলা যায়”, তাহলে পথ খুলে যাবে যে কেউ যেকোনো আয়াতকে “মানসূখ” বলে সরিয়ে দিক। এটাই হবে কুরআনের অলঙ্ঘনীয় হেফাজতের সবচেয়ে বড় আঘাত। তাই মানসূখ আয়াতগুলো রয়ে গেছে কুরআনের বুকে—এক অটুট বাঁধ হয়ে, যা তাহরীফের হাত থেকে কিতাবুল্লাহকে চিররক্ষা করছে।
আর তাদের তিলাওয়াত? তাও বরকতময়। কারণ তিলাওয়াত কেবল হুকুম পালনের জন্য নয়—এ হলো আল্লাহর কালামের সঙ্গে সংযোগ, ঈমানের সতেজতা, তাদাব্বুরের পথ। এই আয়াতগুলো পড়তে পড়তে আমরা বুঝতে পারি— ইসলাম কীভাবে সমাজকে ধাপে ধাপে তৈরি করেছে, কীভাবে আদর্শ ও বাস্তবতার মাঝে সেতু বেঁধেছে।
একটি কথা মনে রাখা জরুরি: নাসখ-মানসূখ কখনো দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিতে স্পর্শ করেনি। তাওহীদ, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা, ইবাদত— এসবের কিছুই কখনো বদলায়নি। যা বদলেছে কেবল কিছু সমাজিক ও ব্যবহারিক বিধান— যেগুলো সময়, পরিবেশ ও মানুষের সামর্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ছিল।
বুদ্ধিও এই নাসখকে স্বীকার করে। যেমন শিশু, কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কের পাঠ্যক্রম এক হয় না, তেমনি সমাজের শিক্ষাক্রমও ধাপে ধাপে। এই ধাপ পরিবর্তন আইনকারীর দুর্বলতা নয়, বরং তাঁর সর্বোচ্চ হিকমত ও মানুষের প্রকৃতিকে গভীরভাবে জানার প্রমাণ।
আর শেষ কথা: মানসূখ আয়াতের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। অধিকাংশ আলেমের মতে দশটিরও কম। এমনকি যেগুলোকে অনেকে মানসূখ মনে করেন, গভীর দৃষ্টিতে দেখলে সেগুলোর প্রত্যেকটিরই স্বতন্ত্র হুকুম ও স্থান রয়েছে।
তাই কুরআন আজও অক্ষত, অপরিবর্তিত, চিরনূতন—আর প্রতিটি আয়াত, মানসূখ হোক বা নাসখ, আল্লাহর কালামের এক একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।
অনুবাদ: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন
আপনার কমেন্ট